ব্রেস্ট ক্যান্সার আমাদের সমাজে এক নীরব ঘাতক। প্রতিদিন হাজারো নারী এ রোগের কবলে পড়ছেন। অনেকেই জানেন না, সঠিক সময়ে পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারলে এই রোগকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাই, নিজের যত্ন নেওয়া এবং নিয়মিত ব্রেস্ট ক্যান্সারের পরীক্ষা করানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আমরা সহজ ভাষায় ব্রেস্ট ক্যান্সার চিহ্নিতকরণের বিভিন্ন পদ্ধতি আলোচনা করব, যা আপনাকে বা আপনার কাছের কাউকে এই রোগ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে।
১. নিজেই ব্রেস্ট পরীক্ষা করুন (Breast Self-Examination বা BSE)
নিজের ব্রেস্ট পরীক্ষা করা সবচেয়ে সহজ এবং প্রথম ধাপ। অনেক সময় নিজেই নিজের শরীরের পরিবর্তনগুলি বোঝা সম্ভব হয়। এই পরীক্ষা প্রতিমাসে একবার করা উচিত, মাসিকের ৫ থেকে ৭ দিন পর। এতে ব্রেস্ট নরম থাকে, পরিবর্তনগুলি সহজে বোঝা যায়।
কিভাবে নিজে পরীক্ষা করবেন?
- আয়নার সামনে দাঁড়ানঃ ব্রেস্টের আকার, আউটলাইন, ত্বকের রং, এবং স্তনের চারপাশের পরিবর্তনগুলো খেয়াল করুন। ব্রেস্টে কোনো অস্বাভাবিক চাকা বা ফোলা দেখতে পেলেও মনোযোগ দিন।
- হাত ওপরে তুলুনঃ এই অবস্থায়ও একই পর্যবেক্ষণ করুন। আকার বা আকৃতিতে কোনো পরিবর্তন দেখতে পান কিনা দেখুন।
- হালকা চাপ দিয়ে অনুভব করুনঃ শুয়ে পড়ুন বা দাঁড়িয়ে নিজের হাত দিয়ে ব্রেস্টের বিভিন্ন অংশে হালকা চাপ দিয়ে দেখুন। বিশেষ করে আঙুল দিয়ে ব্রেস্টের চারপাশে গোল আকারে ঘুরে ঘুরে অনুভব করুন, কোনো শক্ত চাকা বা ফুলে যাওয়া অনুভূত হলে বিশেষ গুরুত্ব দিন।
- আন্ডারআর্ম বা কাঁধের নিচেও পরীক্ষা করুনঃ কারণ, ব্রেস্ট ক্যান্সার শুধুমাত্র ব্রেস্টে সীমাবদ্ধ থাকে না, আন্ডারআর্মে বা লিম্ফ নোডেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
২. ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট পরীক্ষা (Clinical Breast Examination)
নিজে নিজে পরীক্ষা করলেও, বছরে একবার বা দুবার চিকিৎসকের পরামর্শে ব্রেস্ট পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। অভিজ্ঞ চিকিৎসক বা নার্স ব্রেস্ট পরীক্ষা করে কোনো পরিবর্তন হলে তা শনাক্ত করতে পারেন। আপনার বয়স ২০-৪০ হলে ৩ বছর পরপর এবং ৪০ বছরের বেশি হলে প্রতি বছর CBE করানো উচিত।
৩. ম্যামোগ্রাম টেস্ট
ম্যামোগ্রাম হল স্তন ক্যান্সারের জন্য সবচেয়ে সাধারণ স্ক্রীনিং পরীক্ষা। স্তনের একটি এক্স-রে যা অনুভব করতে খুব ছোট টিউমার এবং মাইক্রোক্যালসিফিকেশন সনাক্ত করতে পারে। ৪০ বছরের পর থেকে প্রতি এক থেকে দুই বছরে ম্যামোগ্রাম করানো উচিত।
কিভাবে ম্যামোগ্রাম কাজ করে?
ম্যামোগ্রামে রেডিওগ্রাফিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্রেস্টের ভিতরের ছবি নেওয়া হয়। এতে ব্রেস্টের টিস্যুর যেকোনো অস্বাভাবিকতা, ছোট ছোট টিউমার বা ক্যান্সারের আলামত ধরা পড়ে।
৪. আল্ট্রাসনোগ্রাম এবং এমআরআই (Ultrasound এবং MRI)
অনেক সময় ম্যামোগ্রামে কিছু অস্বচ্ছ বা সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেলে চিকিৎসক আল্ট্রাসনোগ্রাম বা এমআরআই টেস্ট করানোর পরামর্শ দেন। আল্ট্রাসনোগ্রাম ব্রেস্টের ভিতরের অংশে সুস্পষ্ট ছবি দেখাতে সাহায্য করে। তবে যাদের ডেন্স ব্রেস্ট টিস্যু আছে, তাদের ক্ষেত্রে MRI অধিক কার্যকর।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষণ এবং যেসব পরিবর্তন দেখতে পান
ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিভিন্ন লক্ষণ থাকতে পারে। কিছু সাধারণ লক্ষণ হল:
- ব্রেস্ট বা আন্ডারআর্মে কোনো শক্ত চাকা অনুভব করা।
- ব্রেস্টের ত্বকের রং পরিবর্তন, যেমন লালচে হয়ে যাওয়া।
- ব্রেস্টের আকারে আকৃতির পরিবর্তন।
- ব্রেস্ট বা নিপল থেকে রক্ত বা অন্য কোনো তরল নির্গমন।
- নিপল ভিতরের দিকে ঢুকে যাওয়া।
স্তন ক্যান্সারের কারণ কি?
স্তন ক্যান্সারের যে কারণে হতে পারে:
- হরমোন
- প্রদাহ
- বংশগত বা পারিবারিক ইতিহাস
- লাইফস্টাইল
- পরিবেশগত ট্রিগার
সচেতনতার:
ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে কিছু সতর্কতা মেনে চলতে পারেন। যেমন:
- শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন: নিয়মিত শরীরচর্চা করে নিজেকে ফিট রাখা ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
- সুষম খাদ্যাভ্যাস: স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা: অতিরিক্ত ওজন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
- অ্যালকোহল এবং ধূমপান পরিহার করা: ধূমপান এবং অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
পরিবারের ইতিহাস থাকলে করণীয়
যদি পরিবারের মধ্যে কারও ব্রেস্ট ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে, তবে আপনাকে আরও সচেতন হতে হবে। পরিবারের ইতিহাস থাকলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে। এ ক্ষেত্রে আপনাকে আরও নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজন হলে জেনেটিক টেস্ট করাতে পারেন। এতে পূর্বেই ঝুঁকিগুলি সম্পর্কে জানা যাবে, যা রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
ক্যান্সারের প্রতি সচেতন থাকুন
ব্রেস্ট ক্যান্সার অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে চিকিৎসা সহজ হয় এবং নিরাময়ের সম্ভাবনা থাকে। দেরি না করে নিয়মিত চেকআপ করানো এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা জরুরি। আপনার সচেতনতা আপনার জীবন বাঁচাতে পারে।